ঘুরে আসুন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহের কুঠিবাড়ী



ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই- ছোট সে তরী
                আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরী

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর কবিতা সোনার তরীর কয়েকটা পংক্তি। কয়েকমাস আগে চাকরিসূত্রে বসবাস শুরু করেছি খুলনায়। ডুমুরিয়ার চহেড়া গ্রামে ছোট্ট একটা খালে সদ্য কাটা ফসলে ভর্তি নৌকা দেখে মনে পড়লো এ কবিতার কয়েকটি লাইন।

কবির শ্বশুরবাড়ি ছিল খুলনার ফুলতলার দক্ষিণডিহিতে। অনেক দিন আগে একবার সেখানে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু শিলাইদহে অবস্থিত রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীতে যাওয়া হয়নি। আসলে কুষ্টিয়া জেলাতেই আমি এখনও যাইনি, যেতে পারলে দেশে আমার ভ্রমণ করা ৬০ তম জেলা হবে।

ঠিক করে রাখলাম কোনো এক সপ্তাহান্তে ঝটিকা সফর দেব কুষ্টিয়ায়। খুলনার সাথে কুষ্টিয়ার বাস চলাচল বেশ ভালো, গড়াই নামের একটা বাসকে আমার বাসার কাছে থেকেই ছাড়তে দেখি। তবে ট্রেনে যাওয়াটাই আমার করছে বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। এদিকে খুব কাছের একজন বন্ধু রনি কুষ্টিয়াতে বদলি হয়ে এসেছে বছরখানেক হলো। সেও দাওয়াত দিয়ে রেখেছে।


জুনের প্রথম দিনটাই বেছে নিতে হলো। শুক্রবার সকালে আমরা রওনা দিলাম কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে। আমরা মানে আমি আমার স্ত্রী, ১১ মাস বয়সি ছেলে আর বাল্যবন্ধু জালাল। আগের রাতে অনলাইনে ট্রেনের এসি টিকেট পাইনি, ভাবলাম স্টেশনে গিয়ে একটা ঝুঁকি নিয়ে দেখবো পাই কিনা, আর না পেলে নন এসিতেই যেতে হবে।

সকালে স্টেশনে এসে দেখি ভয়াবহ ব্যাপার। অনেক লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, টিকেটের জন্য। মনে মনে রাতে এসির লোভে টিকেট না কাটার জন্য নিজের মুণ্ডুপাত করতে করতে লাইনে দাঁড়ালাম। মিনিট দশেক বাকি আছে ট্রেনের, ঠিক সকাল ৮:৪০ এ চিত্রা এক্সপ্রেস ছেড়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে, পোড়াদহ স্টেশনে নামতে হবে আমাদের।

বেশ দ্রুতই লাইন শেষ হয়ে গেল, ট্রেন ছাড়ার ৪ মিনিট আগে টিকেট হাতে পেয়ে দৌড় দিলাম প্লাটফরমের দিকে, আগে থেকেই ওখানে দলের বাকিরা অবস্থান করছিল। মোটামুটি দৌড়ে ট্রেনে উঠে সিটে বসতে বসতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। মনে পড়লো চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেন ধরতে বন্ধুদের সাথে ট্রেনের পেছনে দৌড়ানোর দৃশ্য।


দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভালোই গরম পড়ে। ট্রেনের জানালা দিয়ে আসা বাতাস সে গরম খুব একটা কমাতে পারছে না, গ্রামবাংলার দৃশ্য দেখতে ভালোই লাগছিল। সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে ট্রেন থামলো পোড়াদহ স্টেশনে। স্টেশন থেকে নেমে বের হবার পর সিএনজি পাওয়া যায়।

জনপ্রতি ২০ টাকা করে ৫ জন এক সিএনজিতে কুষ্টিয়া শহরে যাওয়া যায়। রনির বাসা কোর্ট স্টেশনের উল্টো দিকে, দরাদরি করে ১৫০ টাকা দিয়ে সিএনজি ঠিক করে উঠে পড়লাম। বাসায় এসে ব্যাগপত্র রেখে আগে গেলাম জুমার নামাজ পড়তে। ফিরে এসে দেখি ভালোই বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনজন- জালাল, আমি আর রনি মিলে দেখে আসলাম লালনের সমাধি।

রাতে আলোচনা করে ঠিক করলাম ঢাকা থেকে আসা ১২.১৫ এর সুন্দরবন এক্সপ্রেসে আমরা ফিরে যাব খুলনায়। তাই সকাল ৮টার মধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে হবে কুমারখালীতে কবিগুরুর কুঠিবাড়ীতে। ফিরে এসে সোজা স্টেশনে। এদিকে রনি তার বাসায় ফোন করে ঝিনাইদহ থেকে তাদের একটা গাড়ী আনার ব্যবস্থা করল।

সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কাজ ছিল ট্রেনের খবর নেয়া। মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে জানত পারলাম ট্রেন দু’ঘণ্টা দেরি করে আসবে। জীবনে মনে হয় প্রথম ট্রেন লেইটের ঘটনায় আমি এরকম আনন্দিত হয়েছি। ফলে সকাল ৮টার পরিবর্তে বের হতে হতে আমাদের ৯ টা বেজে গেলো।

কুষ্টিয়া থেকে কুমারখালী ১৫ কিমি দূরত্ব। রাস্তা ভালো হলো ২০ মিনিটেই যাওয়া যেত। দেখা গেল রাস্তার অবস্থা বেশ করুণ। বিশেষ করে কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা সড়ক ছেড়ে বাম দিকে শিলাইদহের রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। সেই ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে ৫০ মিনিটে আমরা পৌঁছে গেলাম কুঠিবাড়ীতে।

১১ একর জমির উপর রবিন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী এখন রবীন্দ্র জাদুঘর। ১৮০৯ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রপিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এই অঞ্চলের জমিদারি লাভ করেন। ১৮৮৯ সালে জমিদারি দেখাশোনা করতে তরুণ কবিগুরু প্রথমবারের মতো এখানে আসেন।

১৮৮৯ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারি পরিচালনা করেন। এসময়ের মধ্যে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সোনার তরী, চিত্র, চৈতালি ইত্যাদি। এছাড়া গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ কাজও এখানে করেন, পরবর্তীতে ১৯১৩ সালে ”গীতাঞ্জলি” কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কার পান।

কবিগুরুর জীবনে এই কুঠিবাড়ীর বিশাল অবদান রয়েছে যেটা তিনি নিজেই বলেছেন, “আমার যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্যরস-সাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মা-প্রবাহচুম্বিত শিলাইদহ”। সাহিত্য চর্চার জন্য এই কুঠিবাড়ীটি ছিল উর্বর স্থান। ১৬ কক্ষের এই বাড়ির তিনতলায় কবির কক্ষ থেকেই দেখা যেত পদ্মা ও গড়াই নদী।


২০ টাকার টিকেট কেটে আমরা যখন বাড়িতে ঢুকি তখন মনে হচ্ছিল ইতিহাসের একটি অধ্যায়ে ঢুকছি। লম্বা লন পেরিয়ে কুঠিবাড়ীর নিচতলায় ঢুকে দেখতে পেলাম কবির নিজ হাতে আঁকা বিভিন্ন ছবি। এছাড়া নিচ তলায় রয়েছে কবির ব্যবহৃত ফাইল কেবিনেট, বিভিন্ন ধরনের পালকি।

কবির হাতের লেখা কেমন ছিল, ইংরেজি চিঠি, তাঁর বিভিন্ন বয়সের ছবি দেখতে দেখতে যেন ফিরে গেছি গত শতাব্দীর শেষ ভাগে। কানে বাজছিল “আজি হতে শতবর্ষ পরে” কবিতার কয়েকটি লাইন।দোতলায় উঠে পেলাম কবির শয়নকক্ষের খাট, আজও বেশ শক্তপোক্ত আছে। দোতলার বারান্দাটা অনেক সুন্দর। সেখানে দাঁড়িয়ে উপর থেকে পুরো কুঠির উঠোনটা দেখা যায়। উপরে রয়েছে সে সময়কার কবির ব্যবহৃত ইঞ্জিন চালিত বোট, লোহার পল্টন।কবির শয়ন কক্ষে তার ব্যবহার করা খাটটা আগের মতই আছে। দোতলা থেকে চোখে পড়লো কুঠির পশ্চিম দিকে পুকুর ঘাট রয়েছে। যেখানে বসে কবি লিখেছিলেন “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে” গানটি। দোতলা থেকে নেমে চলে গেলাম বকুলতলায়। কুঠির সীমানাপ্রাচীর থেকে গেট দিয়ে বিচ্ছিন্ন বকুলতলা।

নানা রকম গাছ দিয়ে ছায়া ঘেরা বাগানের পর একটা পুকুর। পাখির কলতানে মুখরিত জায়গাটা। শান বাঁধানো ঘাটে বকুল ফুলের গাছের নিচে গিয়ে বসলাম। দলের দুই কনিষ্ঠ সদস্য আরিয়ান ও তুলন তখন পড়ে থাকা বকুল ফুল কুড়াতে ব্যস্ত। পুকুরে ভাসছে কবির বজরার আদলে বানানো একটি বজরা। মন হচ্ছিলো সারাটা জীবন যদি এ ঘাটে বসে থাকতে পারতাম।ট্রেনের অবস্থান দেখে বাস্তবে ফিরে আসলাম। ঢাকা থেকে ১ ঘণ্টা ডিলে থাকলেও এখন ২ ঘণ্টা ডিলে। রাস্তার যা অবস্থা দেখলাম তাতে আর থাকার সাহস হলো না। রওনা দিলাম ফিরতি পথে।

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে বাসে করে আসতে পারেন কুষ্টিয়া। এছাড়া সকালের সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে এসে আবার ফিরে যেতে পারেন সন্ধ্যার চিত্রা এক্সপ্রেসে। সকাল ৬:২০ এ ঢাকা ছাড়ে সুন্দরবন এক্সপ্রেস, পোড়াদহ স্টেশনে আসে সাধারণত দুপুর ১২:১৫টায়। আর চিত্রা এক্সপ্রেস পোড়াদহ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়ে রাত ১২টার দিকে, ভোর ৬টায় ঢাকা পৌঁছায়।

কুষ্টিয়া শহর থেকে অটো রিজার্ভ করে ঘুরে যেতে পারেন কুমারখালীর রবীন্দ্র কুঠিবাড়ীতে। আসা-যাওয়া আর ঘণ্টাখানেক অপেক্ষাসহ ৫০০-৬০০ টাকা নেবে। চাইলে রাতে থাকাও যায় কুঠিবাড়ীর ক্যাম্পাসে অবস্থিত গীতাঞ্জলি গেস্ট হাউসে। নন এসি ভাড়া ৫০০ টাকা আর এসি ১,৫০০ টাকা। তবে বুকিং দিতে হবে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদ অফিস থেকে, মেইল করে তারা জানিয়ে দিলেই আপনি থাকতে পারবেন এখানে।

No comments

Theme images by piskunov. Powered by Blogger.