ময়মনসিংহ ভ্রমণ
বাংলাদেশের সপ্তম বৃহত্তম শহর ময়মনসিংহ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী নগরী। শিক্ষা নগরী হিসাবে সুপরিচিত ময়মনসিংহকে যুগে যুগে অসংখ্য গুণীজনেরা তাদের কাজের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করে গেছেন। আর সমৃদ্ধ এই জনপদে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শশী লজ, জয়নুল আবেদিন পার্ক, ময়মনসিংহ জাদুঘর, হাসান মঞ্জিল, আলেকজান্ডার ক্যাসেল এবং মুক্তাগাছা জমিদার বাড়িসহ বেশকিছু দর্শনীয় ভ্রমণ স্থান। রাজধানী ঢাকা ও আশেপাশের অনেক জেলা থেকে অল্প সময়ে ময়মনসিংহ যাওয়া যায়। আর তাই একদিনে ভ্রমণের গন্তব্য হিসাবে এই জেলা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
খুব অল্প সময় অর্থাৎ একদিনের ভ্রমণের ক্ষেত্রে অর্থের চাইতে সময়কে বেশী প্রাধান্য দেয়া উচিত। কারণ সময় বাঁচাতে পারলে আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি সফল ভ্রমণ সম্পন্ন করতে পারবেন। আর এজন্য যে জায়গা থেকেই আপনি যেত চান অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে সকাল ১০ টার মধ্যে ময়মনসিংহ শহরে অবস্থান করার, তার আগে আসতে পারলে আরও ভালো। একদিনে ময়মনসিংহ ভ্রমণে আমরা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শশী লজ, আলেকজান্ডার ক্যাসেলে, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা, জয়নুল আবেদীন পার্ক এবং মুক্তাগাছা জমিদার বাড়িতে ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা তুলে ধরবো। আর সেই সাথে মুক্তাগাছার বিখ্যাত মন্ডা চেখে দেখবো। আপনি চাইলে কোন জায়গা আগে দেখবেন তা নিজের মত ঠিক করে নিতে পারেন। তবে আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভ্রমণ করলে সময়ের অপচয় কম হবে।
ময়মনসিংহ যাওয়ার উপায়
ঢাকার মহাখালী থেকে এনা পরিবহণের বাসে ২২০ টাকা ভাড়ায় প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘন্টায় ময়মনসিংহ জেলা শহরে পৌঁছাতে পারবেন। এনা পরিবহণ ছাড়াও ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ রুটে শৌখিন, শামীম পরিবহন, আলম এশিয়া, শ্যামলী বাংলা এবং ইমাম পরিবহণের বাস চলাচল করে। ঢাকা হতে ময়মনসিংহে আসা বাসগুলো মাসকান্দা বাস স্ট্যান্ড এসে থামে।
ঢাকা থেকে ট্রেনে চড়ে ময়মনসিংহ যেতে চাইলে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন হতে সকাল ৭ টা ২০ মিনিটে তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনে যাত্রা করলে সকাল ১১টার আগেই ময়মনসিংহে পৌঁছাতে পারবেন। শ্রেণিভেদে জনপ্রতি ট্রেনের টিকিটের মূল্য ১৪০ থেকে ২৫০ টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
মাসকান্দা বাস স্ট্যান্ড থেকে ইজিবাইকে জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়ায় কিংবা ৪০ থেকে ৫০ টাকা রিকশা ভাড়ায় চলে যান প্রথম গন্তব্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে ব্রহ্মপুত্র ব্রিজ সংলগ্ন বাস স্ট্যান্ড এলাকায় আসলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অটো পাবেন। একসাথে বেশি জন থাকলে চাইলে ইজিবাইক রিজার্ভ করে নিতে পারেন।
ময়মনসিংহ শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে প্রায় ১২০০ একর জায়গা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশাল আয়তনের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো এলাকা ঘুরে দেখা বেশ সময়সাপেক্ষ্য তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলের বাগান, বৈশাখী চত্বর, লিচু ও আম বাগান, সবুজ মাঠ, লেক, ফিস মিউজিয়াম, কৃষি মিউজিয়াম, সেন্ট্রাল মসজিদ, বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত, মাছ চাষের পুকুর, গবাদী পশুর খামার, নান্দনিক সড়ক, বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে স্টেশন এবং বিভিন্ন দর্শনীয় ভাস্কর্য ঘুরে দেখতে পারেন।
শশীলজ
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘন্টা দুয়েক ঘুরে আবার চলে আসুন ময়মনসিংহ শহরে। ব্রহ্মপুত্র ব্রিজ বাস স্ট্যান্ড এলাকা থেকে রিকশা বা অটো নিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবেন শশীলজ।
স্থানীয়ভাবে ময়মনসিংহ রাজবাড়ি নামে পরিচিত শশীলজের প্রধান ফটক পেরিয়ে প্রবেশ করলে মূল ভবনের সামনে একটি চমৎকার বাগান চোখে পড়ে। আর বাগানের মাঝখানে শ্বেতপাথরের ফোয়ারার সাথে গ্রিক দেবী ভেনাসের এক মর্মর পাথরের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। মূল ভবনের পেছনে আছে দোতলা স্নানঘর, পুকুর ও মার্বেল পাথরে নির্মিত ঘাট। ২০১৫ সালে ৪ এপ্রিল জাদুঘর স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শশী লজটি অধিগ্রহণ করে।
আলেকজান্ডার ক্যাসেল
শশীলজ থেকে রিকশা যোগে মাত্র ৫ মিনিটের দূরত্বে রয়েছে আলেকজান্ডার ক্যাসেল। আর পায়ে হেটে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহৃত আলেকজান্ডার ক্যাসেলে পৌঁছাতে মিনিট দশেক সময় লাগে।
স্থানীয়ভাবে লোহার কুঠি খ্যাত এই আলেকজান্ডার ক্যাসেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, নবাব সলিমুল্লাহ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, লর্ড কার্জন-সহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ অতিথি হিসাবে রাত্রী যাপন করে গেছেন। বর্তমানে আলেকজান্ডার ক্যাসলের একতলার আটটি ঘরে প্রায় ১৫ হাজার বই রাখা আছে। আর আলেকজান্ডার ক্যাসলের বিপরীত পাশেই রয়েছে দুইটি অশ্বথ বৃক্ষ। এখানে অবস্থানকালীন সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বৃক্ষের ছায়ায় সময় অতিবাহিত করতেন বলে প্রচলিত আছে।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া
আলেকজান্ডার ক্যাসল থেকে বেড়িয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য থানা ঘাটে সেলিম হোটেলে চলে যেতে পারেন। সেলিম হোটেলে সুলভ মূল্যে দেশি খাবার পাওয়া যায়। এছাড়া আরো ভালো মানের হোটেল বা রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে চাইলে সারিন্দা, হোটেল ধানসিঁড়িতে গিয়ে ঢু মারতে পারেন অথবা ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব ক্যান্টিনের মোরগ পোলা চেখে দেখতে পারেন।
জয়নুল আবেদিন পার্ক ও যাদুঘর
খাবার খেয়ে অলস দেহ নিয়ে চলে যান শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কে। ময়মনসিংহ মূল শহরের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন ব্রহ্মপুত্র তীরের এই পার্কটিতে যেতে দূরত্ব অনুযায়ী সর্বনিন্ম ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা রিকশা ভাড়া লাগবে।
নদীর তীরের চমৎকার পরিবেশে অবস্থিত অপূর্ব জয়নুল আবেদিন পার্কটি আপনার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দিবে। বিনোদনের জন্য এখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা, দোলনা, ট্রেন, ম্যাজিক নৌকা, মিনি চিড়িয়াখানা, বৈশাখী মঞ্চ, ঘোড়ার গাড়ি, চরকি এবং বেশকিছু খাবারের দোকান। আর নদীতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আছে সারি সারি নৌকার ব্যবস্থা। জয়নুল আবেদিন পার্কের অন্য প্রান্ত রয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। এত কাছে ঘুরতে এসে জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত সব ছবির ভান্ডার দেখার সুযোগ মিস করা মোটেও ঠিক হবে না। ২০ টাকার টিকেট কেটে হামলে পড়ুন জয়নুল আবেদিনের কর্মময় জীবনের গভীর থেকে অভিজ্ঞতার মুক্তা আহরণে।
মুক্তাগাছা রাজবাড়ি
এবার আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি যা মুক্তাগাছা রাজবাড়ি নামেও পরিচিত। ময়মনসিংহ শহর থেকে মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। টাঙ্গাইলগামী বাসে করে ৩০-৪০ টাকা ভাড়ায় মুক্তাগাছা যাওয়া যায়। এছাড়া ময়মনসিংহের টাউন হলের সামনে থেকে লোকালে বা সিএনজি রিজার্ভ নিয়েও মুক্তাগাছা থেকে ঘুরে আসতে পারবেন। লোকাল সিএনজি ভাড়া ৪০-৪৫ টাকা। আর রিজার্ভ নিতে হলে আপনাকে খরচ করতে হবে ২০০-২৫০ টাকা। মুক্তাগাছা যেতে ৪০ থেকে ৫০ মিনিট সময় লাগে।
মুক্তাগাছা নেমে রিক্সা নিয়ে অথবা বাজারের ভেতর দিয়ে একটু হাঁটলে মুক্তাগাছা জমিদার বাড়িতে পৌঁছে যাবেন। মুক্তাগাছার বিখ্যাত মন্ডা খেতে ভুলে গেলে আপনার এই আনন্দময় ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যাবে। জমিদার বাড়ির সামনেই আছে আদি ও আসল দেড়শত বছরের ঐতিহ্যবাহী গোঁপাল পালের মন্ডার দোকান। দোকানে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা যেমন আছে চাইলে সাথে করে বাসার জন্যে কিনেও নিতে পারবেন।
এবার বাড়ি ফিরে যাবার পালা, মুক্তাগাছা থেকে লেগুনা, সিএনজি কিংবা বাস দিয়ে পুনরায় ময়মনসিংহ শহরে ফিরে আসুন। ময়মনসিংহের মাসকান্দা বাস স্ট্যান্ড থেকে এনা, শৌখিন, শামীম পরিবহন, আলম এশিয়া, শ্যামলী বাংলা অথবা ইমাম পরিবহণের বাসে করে ২ থেকে ৩ ঘন্টার মধ্যে ঢাকায় ফিরতে পারবেন। মাসকান্দা বাস স্ট্যান্ড থেকে রাত ৮ টায় সর্বশেষ বাস ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এছাড়া ট্রেনে করে ঢাকায় ফেরার সুযোগও রয়েছে। ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেন সোমবার বাদে প্রতিদিন বিকেল ৫ টা ১০ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আর অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ছাড়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭ টা ১৫ মিনিটে। ট্রেনে চড়ে ঢাকা পৌঁছাতে ৩ থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা সময় লাগে।
কিছু টিপস…
- মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি ছাড়া বাকি সব জায়গা গুলো ময়মনসিংহ শহরের ভিতরই। খরচ কমাতে চাইলে লোকাল ইজি বাইকে চলাচল করতে পারেন। আবার একসাথে কয়েকজন যদি থাকেন তাহলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যাওয়ার জন্যে ইজিবাইক রিজার্ভ করে নিতে পারেন।
- মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি যেতে এবং তা দেখে ফিরে আসতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা লাগবে। বাকি সব দেখার পর যদি মনে হয় সময়ের সল্পতা তাহলে লিস্ট থেকে বাদ দিয়ে হাতে যে সময় আছে তা শহরেই ব্যয় করতে পারেন। অথবা আরেকটা ভালো উপায় হতে পারে দুপুরে খেয়ে মুক্তাগাছা রওনা হতে যেতে পারেন, মুক্তাগাছা থেকে ফিরে এসে বাকি সময় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কে কাটিয়ে দিতে পারেন।
- সময়ের সাথে সব ধরণের পরিবহণের ভাড়া এবং অন্যান্য খরচের পরিমাণ পরিবর্তিত হতে পারে। তাই আপনি পরিকল্পণা করার সময় তখনকার ভাড়া ও খরচ যাচাই করে নিবেন।
No comments